সীমান্ত পথের রোমাঞ্চ

ভ্রমণ স্থানঃ দুর্গাপুর-বিরিশিরি, কলমাকান্দা-পাঁচগাঁও, নিলাদ্রি লেক, বারেক টিলা, সুনামগঞ্জ।

ভ্রমণসঙ্গিঃ Kazi Rakibul Hasan Md Abdullah Al Noman Sharin Alam

এই ভ্রমণে আমরা পাড়ি দিয়েছি ৫৭৭ কিলোমিটার পথ, যার মধ্যে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার ছিল সীমান্তঘেঁষা। যাত্রার সূচনা নেত্রকোনার বিরিশিরি থেকে, আর শেষ সুনামগঞ্জ শহরে। দুদিনের এই অভিযাত্রা ছিল একদম অপ্রত্যাশিত এবং রোমাঞ্চকর। চলেছি নানা ধরনের বাহনে—কার, বাস, সিএনজি, ব্যাটারি অটো, ট্রাক্টর (ধান ও পাথর টানা), মোটরসাইকেল, নৌকা—প্রায় সব ধরনের যানবাহনের স্বাদ এই যাত্রায় পাওয়া গেছে। মাঝে মাঝে বিজিবি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদও ছিল বাড়তি অভিজ্ঞতা!

493729077_10238101861868101_9054505364247241905_n
492147549_10238101820947078_8161046821690774564_n
প্রথম দিনঃ
১৭ এপ্রিল ২০২৫ রাত। আমরা মহাখালী থেকে বাসে চেপে ভোর ৫টায় পৌঁছালাম দুর্গাপুর বাজারে। জনপ্রতি ভাড়া ৪৫০ টাকা, চারজনের মোট ১৮০০ টাকা। নামার পরেই বৃষ্টি আমাদের স্বাগত জানায়। ছাতা বা রেইনকোট কিছুই না থাকায় আমরা বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে ভিজেই ১০০০ টাকায় একটি অটো রিজার্ভ করি। বিজয়পুর সীমান্ত ও সাদা মাটির পাহাড় দেখার উদ্দেশ্যে এবং কামলাকান্দা পরজন্ত।
সকালবেলা নাস্তা করলাম ‘নিরালা’ রেস্টুরেন্টে—ভরপেট খেয়ে বিল এল ৩৭০ টাকা। এরপর যাত্রা শুরু কলমাকান্দার পথে। বিরিশিরি থেকে কলমাকান্দা পথটি সত্যিই মনোমুগ্ধকর—চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত আর তার পেছনে মেঘালয়ের পাহাড়। সেই দৃশ্য দেখে মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে—“একটা পাহাড় যদি আমাদেরও হতো!”
এরপর গেলাম সাত শহীদের মাজারে। তিনদিক ঘেরা ভারতীয় সীমান্ত আর মাঝখানে শহীদদের কবর। সেখান থেকে চন্দ্রডিঙ্গার পথে যাত্রা, যেখানে মনসা দেবীর অভিশাপে চাঁদ সওদাগরের নৌকা নাকি পাথরে পরিণত হয়েছে—এমন কিংবদন্তির স্থানে দাঁড়িয়ে যেন ইতিহাস ছুঁয়ে দেখছিলাম। মনসা মন্দির এবং নৌকা-আকৃতির পাহাড় দেখে মুগ্ধ হলাম।
তাবু গেঁড়ে চন্দ্রডিঙ্গার পাশে রাত কাটানোর পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু বিজিবি স্যারের ওয়াজ শুনে সে ইচ্ছা বাতিল করতে হলো। এরপর যাত্রা শুরু নিলাদ্রি লেকের দিকে, কিন্তু এ পথের দীর্ঘতা প্রায় ৫০ কিমি, সন্ধ্যা নেমে আসছে আর কেউ যেতে রাজি না। বাধ্য হয়ে আমরা পথ ভেঙে ভেঙে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
প্রথমে পাঁচগাঁও—সেখানে খেলাম দেশি হাঁস আর স্থানীয় চালের ভাত, স্বাদ ছিল অসাধারণ! চারজনের বিল ৬৭০ টাকা। মোটরসাইকেলে উঠতে না পেরে আবার অটোতে বসলাম। বাগলি বাজারে (ভাড়া ২৫০ টাকা) নামিয়ে দিল। এরপর ধান বোঝাই একটি ট্রাক্টরে কিছুদূর যাত্রা, তারপর আবার অটোতে চেপে শেষমেশ সন্ধ্যায় পৌঁছালাম নিলাদ্রি লেকে (ভাড়া ২৬০ টাকা)।
নিলাদ্রি লেক সন্ধ্যার আলো-আধারে যেন স্বর্গীয় মনে হচ্ছিল। পরে অনেক খুঁজে বর্ডারের কাছে একটি হোস্টেল-টাইপ হোটেলে উঠলাম—১২০০ টাকায় চারজনের রুম। রাতের খাবার খেলাম টেকেরঘাটের সামিম হোটেলে—দেশি জাতের বয়লার মুরগি, যার স্বাদের চোটে আমরা অবাক! বিল ৭০০ টাকা।
দ্বিতীয় দিনঃ
ভোরে আবার গেলাম নিলাদ্রি লেক আর বরছরা ঝর্ণা দেখতে। ভারত থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানি আর পাথরে ভরা নদীচর যেন মুগ্ধ করল আমাদের। এরপর অটোতে করে গেলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার দেখতে, কিন্তু পানির স্তর কম থাকায় হতাশ হতে হলো। ফেরার পথে বাধ্য হয়ে উঠলাম পাথরবোঝাই ট্রাক্টরে—ঝাঁকুনিতে পুরো শরীর কেঁপে উঠল!
সকালের নাস্তা সেরে হোটেল থেকে চেকআউট করে রওনা দিলাম শিমুল বাগান ও জাদুকাটা নদীর দিকে। প্রচণ্ড রোদের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম শিমুলবাগান—সারি সারি লাল শিমুল গাছ আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো তুলা, এক অপার সৌন্দর্য। এরপর দীর্ঘ হাঁটার পর পৌঁছালাম বারেক টিলায়। টিলার চূড়া থেকে দেখা জাদুকাটা নদীর দৃশ্য ছিল মোহময়।
পরে ১০ টাকা দিয়ে খেয়া পার হয়ে সিএনজিতে রওনা দিলাম সুনামগঞ্জের দিকে। দুপুরে খেলাম গরুর মাংস, ভাত আর ভর্তা দিয়ে। সবশেষে, রাত ১০:৩০ টায় হানিফ বাসে করে ফিরে এলাম ঢাকায়, জনপ্রতি ভাড়া ৮০০ টাকা।
________________________________________
শেষ কথা: এই ভ্রমণ শুধু পাহাড়, নদী আর প্রকৃতি দেখার নয়—এটা ছিল বাস্তবতার সঙ্গে মিশে থাকা একেকটি অভিজ্ঞতার গল্প। প্রতিটি বাঁকেই ছিল চমক আর রোমাঞ্চ।

Leave a Reply